নীল শাড়ি ঘেরা — গল্প
নীল শাড়ি ঘেরা
সৌমী চৌধুরী
শিবপুর কলোনি। নামেই কলোনি। কিন্তু, এখানে বহুতল বাড়ির সংখ্যা নেহাত কম নয়। চায়ের দোকান, মুদিখানা – এসব ছাড়া সবই পাকা বাড়ি। কলোনিটা তৈরি হয়েছে বেশিদিন হয় নি। এখন আর মাত্র দুটো বাড়ি নির্মীয়মাণ। এর মধ্যেই বাড়ি গুলোতে লোক এসে গেছে। সবগুলোই ফ্ল্যাট বাড়ি। নিজের তৈরি বাড়ি এখানে কারুরই নেই। এই শিবপুর কলোনির পশ্চিম দিকের ব্লকে একটা ফ্ল্যাট বাড়ির তিনতলায় থাকে শ্রবণা। একাই থাকে। বাবা-মা আছেন। কিন্তু, বাবার কর্মস্থলেই থাকেন তাঁরা। শ্রবণা এখনও পড়াশোনা করছে আর সেজন্যেই এখানে থাকা।
শ্রবণার মা তো প্রথমে কিছুতেই ছাড়তে চান নি। নিজেও প্রায় একমাস প্রথমদিকে মেয়ের সাথে কাটিয়ে গেছেন। বাড়ির মালকিনকে পছন্দ হয়েছে বলেই না তিনি মেয়েকে একা রাখতে ভরসা পেয়েছেন। নইলে কবেই… এখনও মাঝে মাঝেই এক-দুদিনের জন্য আসেন। এই তো গত সপ্তাহেই ঘুরে গেলেন। শ্রবণার যাতে খাবার অসুবিধে না হয় তাই একটা রান্নার লোকও ঠিক করে দিয়েছেন। সে-ই দুবেলা, কখনো একবেলা এসে রান্না করে দিয়ে যায়।
বেলা ৯ টা। শ্রবণা এখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। অন্যদিন খুব ভোরে উঠতে হয়। আজ বাস-ট্যাক্সি ধর্মঘট। তাই বাইরে মানে কলেজে বা পড়তে যাওয়ার কোন কথায় নেই। সেই জন্যই এতো বেলা অবধি ঘুম। ঘুম ঠিক না, ঘুম অনেক ক্ষণ ই ভেঙ্গেছে, কিন্তু খবরের কাগজের অপেক্ষা করছিল। ভোরবেলা উঠে খবরের কাগজ হাতে না করলে মনটা ভালো লাগে না। আজকে ধর্মঘটের জন্য বোধ হয় কাগজ আসতে দেরি হচ্ছে।
বারান্দায় কাগজ পড়ার শব্দ হল। নাহ্, এবার উঠতেই হয়। আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। ইশ্…সোয়া ৯টা বেজে গেছে! স্কুললাইফে এতো দেরি করে কোনদিন উঠেছে কি না মনে পড়ছে না। মুখ না ধুয়েই কাগজ নিতে গেল বারান্দায়। এই রে, আজকে নীল শাড়ি শুকোতে দেওয়া হয়ে গেছে! হ্যাঁ, এই নীল শাড়ি, তার মালকিন আর মালকিনের মালিককে নিয়ে শ্রবণার অগাধ কৌতূহল। এরা সকলেই শ্রবণার সামনের ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলার বাসিন্দা। সেই সকালবেলা থেকে এঁদের স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। কেউ কমতি যায় না। একবার এ থামে তো ও শুরু করে। আবার, ও থামলে এ নতুন প্রসঙ্গ টানে। কি কথা হয়, তা ঠিক বোঝা যায় না, তবে যে সেটা ঝগড়াই সেটা বুঝতে শ্রবণার অসুবিধে হয় না। এদের দেখতেই শ্রবণার সকালের কিছুটা সময় কেটে যায়। চশমা পরলে সকালের স্নিগ্ধ বাতাস চোখে লাগবে না বলে শ্রবণা চশমা খুলেই বারান্দায় দাঁড়ায়। তাই ওই দম্পতির মুখ পরিষ্কার করে দেখতে পায় না। কিন্তু, ওর এটা দেখে খুব ভালো লাগে যে, বউটা কত যত্নসহকারে স্বামীর অফিস যাওয়ার আগে টিফিন বাক্সটা হাতে ধরিয়ে দেয়। তারপর বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এসময় ওর পরনে থাকে একটা নীল শাড়ি। নিচে নেমে রাস্তায় এসে বর টা হাত নাড়ায়। মোড়ের গাছের আড়ালে চলে না যাওয়া অবধি বউটা দাঁড়িয়ে তার যাওয়া দেখে। তারপর ঘরে ঢুকে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার বারান্দায় আসে নীল শাড়িটা শুকোতে দিতে। এসব রোজকার ঘটনা। বউটা বোধ হয় রোজ রাত্রে এই শাড়িটা পরেই শোয়, নইলে রোজ ওই একই শাড়ি শুকোতে দেবে কেন। শাড়ি শুকোতে দিয়ে বউটা ঘরে ঢুকে বারান্দার দরজা দিয়ে দেয়। শ্রবনাও তখন ঘরে চলে আসে। কারণ ততক্ষণে ওর খবর কাগজ দেখাও শেষ হয়ে যায়।
আজকে কিন্তু দিনটা একটু অন্যভাবে শুরু হয়েছে। রোজকার এই ঘটনা আজকে শ্রবণার ঘুম থেকে ওঠার আগেই ঘটে গেছে। ও আজ আর কাগজ পড়লো না। ঘরে ঢুকে বিছানায় কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাথরুমে গেল। বাথরুম থেকে এসে দেখে টেবিলে প্রিন্ট করে আনা ছবির খামখানা পড়ে আছে। কালকেই এনেছে, ইচ্ছে করছিল না বলে আর দেখে নি। এখন তাই ছবিগুলো দেখবে বলে বসলো। কিন্তু কয়েকটা দেখার পরই গা-টা ম্যাজ ম্যাজ করায় বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। বোধ হয়, কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়েই পড়েছিল। কলিং বেলের আওয়াজে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো।
ঘড়িতে এখন এগারোটা, এখন তো কারুর আসবার কথা নয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা থেকে শরীরটা তুললো। দরজা খুলে দেখে অতীশ এসেছে। শ্রবণা তো অবাক!
– ‘ওমা! কি রে তুই!’
– ‘কেন? আসতে পারি না বুঝি?’
– ‘না তা নয়, এমনিই আর কি… তা কিসে এলি?’
– ‘স্রেফ হেঁটে’
– ‘হেঁটে? এই রোদে?’
– ‘হুঁ… কি করবো? বাস টাস কিছু চলছে না… ভালো লাগছিলো না… ভাবলাম কোথাও একটা যাই… তাই চলে এলাম…’
অতীশ চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘আজ দুপুরটা বুঝলি তোর এখানেই কাটাবো… খেয়ে দেয়ে একেবারে বিকেলে ফিরবো… এই রোদে আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না… কি রে কোন অসুবিধে হবে না তো তোর?’
শ্রবণা সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠে – ‘না, না, অসুবিধে কিসের? তাছাড়া তোর কাছ থেকে আমার কিছু নোটও বুঝে নেওয়ার ছিল… আজকে তুই না এলে তোকে একবার ফোন করতামই…’
– ‘তাহলে এসে ভালোই করেছি কি বল? তা মাসী আজ কি রান্না করেছে?’
– ‘মাসী! মাসী আজকে আসেই নি… কাল সকালে এসে এক বেলার রান্না করে চলে গেছে… মেয়ের জ্বর হয়েছে, সেটা না সারা অবধি আসবে না…’
– ‘তাহলে খাওয়ার দফা রফা…’
– ‘কেন? আমি রাঁধবো…’
অতীশ বেশ একটা ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলে, ‘তুই? তুই রাঁধবি? ওষুধের দোকানের পাশ দিয়ে এলাম রে… আগে জানলে কিছু ওষুধ কিনে আনতাম…’
– ‘হ্যাঁ, তুই তো চিরকালই আমায় under estimate করে গেলি…’
– ‘দেখ শ্রবণা, তোর মতো আজব জন্তুকে আমরা যে বন্ধুবৃত্তে রেখেছি, সেটাই বড় কথা… বরং জন্তু বলে তোকে over estimate করে থাকি আমরা…’
শ্রবণা অভিমান ভরা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ ভাই, তোদের অসীম করুণা, তাই আজ জন্তুর বাড়িতে খেতে এসেছিস…’
– ‘কি! আমি খেতে এসেছি!’ – অতীশ রেগে যায়, বলে – ‘ঠিক আছে, আমি আসছি তাহলে…’
– ‘আরে না না, ঠাট্টা করছিলাম এমনি… মাঝে মাঝে ভুলে যাই কি না, তোর চামড়া পাতলা, প্রায় না থাকারই মতো… ঠিক আছে, তোর আলাদা ব্যবস্থা হবে…’
শ্রবণা স্নান করতে চলে যায়। স্নান সেরে এসে দেখে, অতীশ বিছানায় ঝিমোচ্ছে। পাশে ছড়ানো খবরকাগজের পাতাগুলো।
রান্না সেরে শ্রবণা খাবারের টেবিলে ডাক দেয় অতীশকে। খাবারের টেবিল বলে আলাদা কিছু নেই। পড়ার টেবিলে বইখাতা একদিকে সরিয়ে কিছুটা জায়গা করা আছে। অতীশ খেতে এসে দেখে ওর পাতে চাউমিন। অবাক হয়ে বলে, ‘কি রে? তুই চাউমিন করেছিস? এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?’
– ‘আমি কি বলেছি যে আমি রেঁধেছি যে বিশ্বাস করবি? আমি শুধু গরম করেছি। কাল রাত্রে দুপ্লেট এনেছিলাম মোড়ের দোকান থেকে। রাত্রে খেয়েছি। বাকিটা পাশের ফ্ল্যাটের রুমাদিদের ফ্রিজে রেখেছিলাম। নিয়ে এলাম গিয়ে। আমি জানি তুই চাউ খেতে ভালবাসিস। আর এটা তোর দুপুরের খাবার হিসেবে মনে হয় না কম হবে।’
অতীশ এবার নিজের ব্যাঙ্গটা সামলে নিয়ে বলে – ‘সে নয় বুঝলাম, তুই খাবি কি?’
– ‘আমি ভাতে ভাত আর ডিম সেদ্ধ। নিজেই করলাম এখনি…’
– ‘তা বইকি, ভাত আর ডিম সেদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো রান্নার রেসিপি যে তোর জানা নেই, খুবই স্বাভাবিক। তা নিজে নিজে গোটা ডিম সেদ্ধ খাবি আর আমাকে দিবি না? বাঃ বাঃ! অতিথি সৎকারের কি নমুনা!’
– ‘তুই কি এখনি খাবি? আমি ভাবলাম, চাউয়ের সাথে ডিম সেদ্ধ খাবি না, তাই তোর ভাগেরটা তুলে রেখেছি, বিকেলে যাওয়ার আগে দেবো বলে।’
খানিকক্ষণ ওরা নিঃশব্দে খায়। তারপর শ্রবণাই বলে ওঠে, ‘এই আঁচার খাবি? ভয় নেই, আমি বানাই নি। পরশু শোধ পুর থেকে ফেরার পথে ট্রেনে কিনেছি। একটা পাঁচমিশেলি আর একটা লঙ্কার।’
– ‘পাঁচমিশেলিটাই দে। আচ্ছা থাক। এখন না। এইমাত্র চাউ খেলাম। বিকেলে খাবো’, বলে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে অতীশ।
শ্রবণা চেঁচিয়ে বলে, ‘একটু দাঁড়া, বিছানাটা ঝেড়ে দিই। সকাল থেকে পরিষ্কার করা হয় নি। তারপর শুস্।’ অতীশ হাত মুখ ধুতে ধুতে বলে – ‘আর তুই?,
– ‘আমি? আজকে অনেক ঘুমিয়েছি। দুপুরটা এমনিই কাটিয়ে দেবো।’
– ‘হ্যাঁ রে, টেবিলে দেখলাম, কিছু ছবি রয়েছে, দেখছি।’
– ‘হ্যাঁ, দ্যাখ,’ বলে শ্রবণা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বারান্দায় এখন রোদ আস্তে আস্তে বাড়ছে। তাই তেজও প্রচণ্ড। বেশিক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকা যায় না। কিন্তু শ্রবণা তাও তাকিয়ে থাকে ঠায় নীল শাড়িটার দিকে। সেই কোন সকালে শুকোতে দিয়েছে! এখনও শুকোয় নি? রঙটা তো জ্বলে যাবে!
ইতিমধ্যে অতীশ বার কয়েক শ্রবণার নাম ধরে ডেকে সাড়া না পেয়ে বারান্দায় আসে। এক হ্যাঁচকায় শ্রবণার একটা হাত টেনে ধরে চেঁচিয়ে বলে – ‘কতক্ষণ ধরে ডাকতে হয় শুনি? এগুলো কি?’ – বলে একগাদা ছবি শ্রবণার মুখের সামনে তুলে ধরে – ‘এগুলো কার ছবি?’
– ‘একটা ছেলের।’
– ‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। ছেলেটা কে?’
– ‘জানি না।’
– ‘দেখলি কোথায়?’
– ‘পি কে-র বাড়িতে।’
– ‘পি কে মানে পীযুষ কোনার? ওঁর বাড়িতে ছেলেটা নতুন পড়তে ঢুকেছে?’
– ‘না, স্যারের ভাই।’
অতীশ আরও উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘তবে যে বললি, ছেলেটা কে, জানিস না?’
শ্রবণা একই টোনে বলে, ‘জানি না-ই তো। এর বেশি আর কিছুই জানি না।’
অতীশ আরও রেগে যায় – ‘পরিচয় হল কি করে? ছবি তুললিই বা কোথায়?’
– ‘ছেলেটাকে স্যারের বাড়িতে দেখে চেনা চেনা ঠেকল। কিন্তু কে কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। তাই, স্যারকে বলে ওইদিন বিকেলে আবার গেলাম নোট বোঝার নাম করে। দেখলাম, স্যার নেই। ছেলেটা তখন স্যারের বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিল। ওর পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। অথচ এতো চেনা চেনা সব… সঙ্গে তো আমার ক্যামেরা থাকেই। আর তুই তো জানিস, ফটো তোলা আমার একটা হবি। তাই ছবিগুলো তুললাম, যদি মনে পড়ে। কিন্তু জানিস, তাও মনে পড়লো না।’
– ‘ওহ্! অসহ্য! তলে তলে এতদূর! আমাকে আগে বলিস নি কেন? তা ছবি তুললি, তুললি, তা বলে একেবারে এক ডজন? সব অ্যাঙ্গেল থেকে মুখের ছবি তুলেছিস! কেন? কেন? আমি জানতে চাই কেন?’
অতীশের এইরকম হিংসুটে রূপটা বেশ উপভোগ করছিল শ্রবণা। ওই নীল শাড়িওলাদের সাথে কোথায় যেন মিল আছে। সেই বারান্দা। সেই ঝগড়া। অতীশকে আরও রাগাতে ও বলল –‘বেশ করেছি। পছন্দ হয়েছে, ভালো লেগেছে, তাই। মাত্র এক ডজন কেন আমি তো পুরো মেমরি কার্ড ভরেই তুলতাম, নেহাত সময় ছিল না, তাই।’
– ‘কি? ভালো লেগেছে? পছন্দ হয়েছে? অসভ্য মেয়ে! আমাকে না জানিয়ে তুই প্রেম করছিস আর কারো সাথে!’ – বলে হাতটা প্রায় মুচকে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে বসিয়ে দিল আয়নার সামনে একটা টুলের ওপর। এবার শ্রবণার বেশ বিরক্ত বোধ হল – ‘দ্যাখ, বেশি খবরদারি করবি না। তুই কে রে? আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই ছবি তুলেছি। তুই কে বলার?’
অতীশ ততোধিক সপ্তমে গলা চড়িয়ে বলে – ‘আমি কে বলার? ইচ্ছে হয়েছে বললেই হল? আর খবরদারি করবো কি না করব সেটা আমার ব্যাপার। আমিও বেশ করবো। ওফ্! তোর মতো জংলী মেয়ে আমি আর দেখি নি কোথাও! দেখো না চুলের বাহার দেখো!’
হঠাৎই অতীশের সব রাগ গিয়ে পড়লো শ্রবণার খোলা চুলের ওপর। শ্রবণার পিঠের মাঝ বরাবর অবধি কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল। স্নান সেরে না আঁচড়ানোয় আরও ফুলে রয়েছে। অতীশ সেই চুল হাতে পেঁচিয়ে এমন জোরে টান দিলো যে, যন্ত্রণায় শ্রবণার চোখে জল এসে গেলো। কিন্তু যতই হোক, মেয়ে তো। হঠাৎ ভীষণ ঠাণ্ডা হয়ে গিয়ে বলল –‘ছেড়ে দে চুলগুলো, ওগুলো আমার একান্ত নিজস্ব।’
কিন্তু শ্রবণার ধীর গলা কমানো তো দূরে থাক, অতীশের রাগ আরও অনেকটা বাড়িয়ে দিলো – ‘হুঁ, আমার নিজস্ব… বার করছি নিজস্ব… তোর সব চুল আমি ছিঁড়ে দেবো। তোর আর নিজস্ব বলে কিছু থাকবে না।’ – বলে সত্যিই শ্রবণার চুলের মুটি ধরে ঝাঁকাতে থাকলো। শ্রবণা কোনোরকমে সেই চুলের মুটি ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াতেই অতীশ বিছানায় বসে বাচ্চা ছেলের মতো হাঁউ হাঁউ করে কেঁদে উঠলো। শ্রবনাও নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সেও অতীশের পায়ের কাছে মাটিতে বসে কাঁদতে লাগলো। শ্রবণা মিছে মিছেই অতীশকে রাগিয়েছে এতক্ষণ, একথা ভাবতেই শ্রবণার কান্না ফেটে বেরোতে লাগলো। আস্তে আস্তে কান্না থামলে বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে শ্রবণাই প্রথম উঠলো। উঠে গিয়ে চিরুনি আর গার্ডার অতীশের সামনে ধরে বলল –‘কি রে ভূত, চুল বেঁধে দিবি না?’
এতক্ষণে বোধ হয় বিশাল এক মহাযুদ্ধের এবং সেই সঙ্গে প্রতীক্ষার অবসান হল।
অতীশ খুব যত্নসহকারে শ্রবণার চুল দুপাশে বেণি করে দিল – ‘কি রে এবারে খুশি তো?’
বাচ্চা মেয়ের মতো ঘাড় নেড়ে শ্রবণা বলে, না । মুখে বললো – ‘আমার একটা ফটো তুলে দিবি? মুখটা পরিষ্কার করে আসছি।’
বহুদিন পর শ্রবণা নিজের ছবি তোলালো।
– ‘সন্ধ্যে সাড়ে ছটা বেজে গেছে। এতক্ষণে বোধ হয় বাস চলতে শুরু করে দিয়েছে। আমি আজকে আসি রে।’
– ‘আর ডিম সেদ্ধটা?’
– ‘ওহো! ওটা তুই একটা টিফিন বক্সে দিয়ে দে। রাত্রে খেয়ে নেবো। আর আঁচারটাও দিস।’
অতীশ বেরিয়ে গেলে শ্রবণা চশমা পরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। অতীশ নিচে থেকে হাত নাড়ে। শ্রবণা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে – ‘কাল আসবি তো?’
– ‘অবশ্যই। আর তোর হাতের রান্না খাবো কিন্তু।’
অতীশ রাস্তার মোড়ের গাছের আড়ালে অদৃশ্য হওয়া অবধি শ্রবণা তাকিয়ে থাকে। তারপরই চোখ ফেরায় নীল শাড়ি ঘেরা বারান্দায়। আজ চশমা পরায় সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। ওই তো বারান্দার দরজা খুলে গেল। শাড়ি তুলতে বউটা বারান্দায় এসেছে, পিছন পিছন ওর বরও।
ওটা কে? পি কে-র ভাই না?