+91 9330828434 +91 9804424251 banglalivenews@gmail.com

গল্প — রশ্মিচ্ছটায় ধ্বস্ত

শুভেন্দু কুমার চট্টোপাধ্যায় - August 30, 2020 1:14 pm - সাহিত্য

গল্প — রশ্মিচ্ছটায় ধ্বস্ত

চিত্র সৌজন্যে: Medium

রশ্মিচ্ছটায় ধ্বস্ত
……………………..

আজ ডাক্তার হিসেবে শপথ নেবে মালদিনি। ছোটোবেলা থেকে ইচ্ছেটা বাসা বেঁধে ছিল মনের মধ্যে। বাবা-মা অবশ্য একমাত্র সন্তানের ইচ্ছেয় কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ান নি। মালদিনি এক বছরের ছোটো একটা বোন ছিল ।তার তিন বছর বয়স যখন অজানা এক জ্বর এসে দুদিনের মধ্যে তাকে সরিয়ে নিয়ে গেল ।
ছোটো থেকে মালদিনির হৈ-হুল্লোড় , খেলাধূলা এসব খুব একটা পছন্দ নয়। বাবা-মা নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকলেও ওকে যেভাবেই হোক কিছুটা সময় দিতেন। ওদের পরিবারটা উচ্চ শিক্ষিত,অভিজাত। অতীতে নাকি ওর কোনো এক পূর্বপুরুষ কাউন্ট ছিলেন । তাঁর জমিদারী কমতে কমতে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকলেও সিনর মালদিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই এখন বিশ্ব-বিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সিনর মালদিনি পড়ান প্রত্নতত্ত্ব ,ম্যাডাম মলিকিউলার বায়োলজি। সেই জন্য ছোটো থেকেই জুনিয়র মালদিনির বিজ্ঞানের ইতিহাস দুটো বিষয়েই সমান আগ্রহ। জুনিয়রের পোশাকি নাম পাউলো মালদিনি।মা-বাবা তাদের সবেধন নীলমণিকে ‘পিট’ বলে ডাকেন।
স্কুলের উঁচু ক্লাস পর্যন্ত পিটের পড়াশোনা নিয়ে বাবা-মাকে কখনো চিন্তা করতে হয় নি। স্কুলের শেষ পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে বাবা জিজ্ঞেস করলেন,’ এবার কি করবে‌?’
‘মেডিকেলে ভর্তি হবো।একজন বড়ো ডাক্তার হতে চাই।’প্রবেশিকা পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য রেজাল্ট করে ইচ্ছাপূরণের প্রথম ধাপে পা রাখল পাউলো মালদিনি।
আজ পাঁচ বছরের পড়ার শেষে ডাক্তার হিসেবে স্বপ্ন ছোঁয়ার দিন। বিরাট হলঘরটা গমগম করছে ছাত্র-ছাত্রীদের ভীড়ে। কনভোকেশনে প্রধান অতিথি হেল্থ মিনিস্টার। মঞ্চে তার পাশে বসেছেন ভাইস চ্যান্সেলর ও মেডিকেল প্রফেশনের কিছু কেষ্টবিষ্টু। নীচে সামনের সারির বা দিক ঘেঁষে বসেছে পিট ।পাশে বসা সুন্দরী তরুণীটির দিকে মাঝে মাঝে চোখ চলে যাচ্ছে। হলভর্তি ভাবী ডাক্তার আর গবেষকরা কনভোকেশনের পোষাকে অধীরভাবে অপেক্ষা করছে অনুষ্ঠান শুরুর জন্য।

পাশের মেয়েটিকে তো আগে কোনোদিন দেখে নি। বোধহয় ডেন্টালের ছাত্রী। ডেন্টাল কলেজ পিটের কলেজ‌ থেকে বেশ খানিকটা দূরে, প্রায় শহরের প্রান্তে বলা চলে। পিটের প্রিয় বন্ধু আন্তোনিও ভিচিনি ঐ রোতেই দুজনের পর বসেছে।মাঝে মাঝে দুই বন্ধুর চোখাচোখি হচ্ছে । অনুষ্ঠান শুরু হলো উপাচার্যের স্বাগত ভাষণ দিয়ে। প্রধান অতিথি হেল্থ মিনিস্টার তাঁর ভাষণে আশা প্রকাশ করলেন আজ যারা ডাক্তার হলো , আগামী দিনে তারা নিশ্চয়ই দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করবে। এটা অন্য কোনো পেশার মতো নয়, এটা একটা মহান পেশা।বক্তৃতা শেষ করে উনি গবেষক ও সদ্য পাশ করা ডাক্তারদের হাতে শঙসাপত্র তুলে দিলেন।
কি ব্রেকে বাইরে বেরিয়ে পিট দেখে সদ্য ডিগ্রী পাওয়া বন্ধুরা এক জায়গায় জটলা করছে। হলে পাশে বসা সেই তরুণীটি বেরতেই পিটের চোখ ওদিকে। ঠিক ধরেছিল মেয়েটি ডেন্টালের ছাত্রী। নাম ঘোষনার সময় ওর নাম আর বিভাগ ওর জানা হয়ে গেছে। ওর নাম পলা মাইনো । গভীর চোখের দৃষ্টিতে পিটকে নন্দিত করে পলা পাশ কাটিয়ে নিজের স্কুটির দিকে এগিয়ে গেল।

বাড়ি ফিরে পিট দেখলো বাবা-মা ওর জন্য কেবল সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন। নানা খাবারের সমারোহের মাঝে মধ্যমণি হয়ে বিরাজ করছে নানা ফলের টুকরোর টপিঙ দিয়ে সাজানো একটা ঢাউস কেক।কেকের‌একপাশে লাল ক্রিম দিয়ে লেখা’ সাফল্যকে উপভোগ করো –ড্যাড ও মম ‘।
কেক কাটার পর মা জানতে চাইলেন কনভোকেশন‌কেমন হলো? পিট অনেক কথার সঙ্গে পলার কথা বলতেও ভুললো না , এমন কি তার বিরাট দুটো কালো চোখের কথাও। বাবা-মা নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।

রোজ হসপিটাল যাওয়া‌, ওপিডি সামলানো ,রাউন্ড সব কেমন অদ্ভুত নিয়মে চলছে। রাতে খাওয়ার টেবিলে বাবা-মায়ের সাথে কিছু কথা। কিছুদিন পর পিট গবেষক-চিকিৎসক হিসাবে নাম নথিভুক্ত করালো। মেকেল সায়েন্সকে আরো জানতে হবে । এর জন্য আরও পড়াশোনা করার দরকার।
বছর দুয়েক কেটে গেছে।পিট ভাইরোলজির উপরে ডক্টরেট করে‌ এখন নিজের কলেজের চিকিৎসক-অধ্যাপক। একদিন মেডিকেল কলেজ অ্যলুমনি এ্যসোসিয়েশনের সভায় হঠাৎ দেখা পলার সঙ্গে।কনভোকেশনের পর মেয়েটার সঙ্গে আর দেখা হয় নি। স্বপ্নে অবশ্য পিট কতোবার ওর অতল চোখের গভীরে ডুব দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আজ আবার ওকে এখানে রেখে পঁচিশের ছেলেটা হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে রইল।
পলা দূর থেকে একজন সুপুরুষ তরুণকে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ মজা পেল।কুন্চিত ভুরু নিয়ে পলা পিটের কাছে এগিয়ে এলো। প্রথমটা নার্ভাস বোধ করলেও সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে পিট পলার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। চিনতে পেরে পিটের হাতটা ধরে বললো,” ভালো আছেন? এখন কোথায় পোস্টেড?”
“আমাদের পু্রনো কলেজেই চিকিৎসা ও‌ অধ্যাপনা দুটো কাজ করি। আপনি?”
“বাঃ,বেশ।আমি এ .জেড . ডেন্টাল কলেজে আছি , সেইসঙ্গে মুখে নানা ব্যকটিরিয়ার প্রভাব নিয়ে চলছে গবেষণা।”
দাঁতের ডাক্তারের ঝকঝকে দাঁতের মিষ্টি হাসি উপহার পেয়ে পিটের কেমন যেন ঘোর লেগে গেল।

পলা কিছুটা প্রগলভ হয়ে হঠাৎ বলে উঠল,”লাঞ্চের পর আপনার সঙ্গে কিছুটা সময় গল্প করতে চাই, আপত্তি আছে?”
পলা ওর বিশাল চোখের দৃষ্টিতে পিটকে বিদ্ধ করলো। মেয়েদের সঙ্গে এ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশা না করা ছেলেটা‌ এবার শরমে মরে গেল। আগ বাড়িয়ে এরকম প্রস্তাব কথাটা ঠিক হয় নি।আরে মেয়েটার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয়ের অবকাশ ই তো হয় নি এখনো পর্যন্ত।মেয়েটা না জানি পিটের সম্বন্ধে কি না কি ভাবছে।
পিট‌ অবাক হয়ে দেখল ‌পলার আনারকলির মতো ঠোঁটে মৃদু হাসির আভাস , যেন পিটের অবস্থা দেখে মজা পাচ্ছে। পলা এবার ঘাড় নেড়ে ওর সম্মতির কথা জানিয়ে দিল।
অতিথিদের বক্তব্য শেষ। সঞ্চালক লাঞ্চ ব্রেক ঘোষণা করলেন । লাঞ্চের পর সাংগঠনিক আলোচনা ও নতুন কর্মসমিতি গঠন করা হবে। সঞ্চালক সকলে লাঞ্চের পর হলে উপস্থিত হতে বললেন। এখন এসব আর পিটের মাথায় ঢুকছে না।ওর মাথায় এখন ভালোলাগার ভাইরাস ঢুকে গেছে।পিট ভাবছে এটাই বোধহয় প্রেম।
পিট পড়িমরি করে ছুটলো ডাইনিঙ হলের দিকে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোণের দিকে একটা ছোট টেবিলে বসে পড়লো। দু মিনিট পর পলা ঢুকতেই পিট চেঁচিয়ে ওঠে ডাকলো। পলার মুখে আবার মৃদু হাসির ছোঁয়া। আধঘণ্টা পরে দেখা‌ গেল পিট তার স্বপনচারিণীর হাতটি ধরে বকবক করতে করতে সামনের পার্কের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

আজ ডাইনিঙ টেবিলে একসাথে পুরো মালদিনি পরিবার।পিট, পলা,পিটের বাবা-মা ; সেইসঙ্গে পিটের দুই পুত্র -কন্যা। বিয়ের পর থেকে গত দশ বছরে পুরো পরিবার একসাথে লাঞ্চ করছে এটা কদাচিৎ হয়েছে। ছুটির দিনগুলোতেও পিট ,পলাকে হাসপাতাল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। কখনো পিটকে , আবার কখনো পলাকে, বা দুজনকেই। আজকের দিনটাকে ব্যতিক্রম বলা চলে। সাত বছরের ছেলে আর পাঁচ বছরের মেয়ে বাবার দুপাশে বসে। সিনিয়র মালদিনি হঠাৎ পিটকে বললেন,” জানিস তো তুন্দ্রা অন্চলে্র এক জায়গায় খননকার্যের সময় বিজ্ঞানীরা প্রায় এক লক্ষ বছর আগের বল্গা হরিণের মতো এক ধরনের প্রাণীর সম্পূর্ণ দেহ পেয়েছেন ।বরফের তলায় এতোদিন চাপা ছিল , দেহে কোনো বিকৃতি নেই। সবশুদ্ধ আটটা ঐ প্রাণীর শিং সমেত গোটা দেহ। একদল প্রত্নবিদ গবেষণার কাজে ওখানে গিয়ে হঠাৎ ওগুলো আবিষ্কার করেছেন। দেহগুলো তুলে এনে এখন পরীক্ষা করা হচ্ছে।”

এতোক্ষণ পিট খেতে খেতে মন দিয়ে বাবার কথা শুনছিল। এবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,” ঐ পরীক্ষা-, নিরীক্ষা যেসব প্রত্নবিজ্ঞানী ও জীববিজ্ঞানীরা করছেন, তাঁরা ঐ প্রাণীগুলোর‌ মৃত্যুর কারণ হিসেবে এক ধরনের ভাইরাসের ‌কথা বলেছেন।”
পিটের মা ছেলেকে বললেন,” হ্যা, কিন্তু সেটা জানলে তো জানা যাবে ঐসময় পৃথিবীর পরিবেশে ঐ ভাইরাস আর কোন কোন প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। মানুষ তো আদিকাল থেকে নানা ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে তবে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে।”
পিট বললো ,”কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এ আবিস্কারটা নিয়েই মজে আছেন । প্রাচীন পৃথিবীর যেসব জীবাণু এতোদিন নিস্ক্রিয় হয়ে ছিল , তারা যদি কোনো মাধ্যম পেয়ে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে তাহলে মানব সভ্যতা টিকে থাকবে তো? ঐসব জীবাণুর পরিচয় আজকের মানুষের অজানা। বরফের নীচে থেকে পাওয়া ঐসব প্রাণীদের শরীরে বাসা বেঁধে থাকা জীবাণুরা বরফের মোটা স্তরের নীচে চাপা পড়েছিল।এখন কোনোভাবে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে যদি তারা আত্মপ্রকাশ করে তবে মানুষের সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ উপস্থিত হতে যাচ্ছে।”
পিটের বাবা-মা আর কিছু বললেন না।
গতকাল সন্ধ্যায় মিষ্টার আর মিসেস মালদিনি বসার ঘরে একসাথে কফি পান করছিলেন। নাতি, নাতনিরা স্টাডি রুমে। পলা , পিটের ফিরতে দেরি হচ্ছে। হঠাৎ কোণের টেবলে ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো। দুজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। মোবাইলের জমানায় চট করে ল্যান্ড ফোন বাজে না। কিছুক্ষণ এক নাগাড়ে বাজার পর মিসেস মালদিনি উঠে ফোনটা ধরলেন। ওপ্রান্তে পিটের উত্তেজিত গলা শোনা গেল।

“মা ,ভালোই হয়েছে তুমি ফোনটা ধরেছ। আমি আজ ফিরতে পারবো না ,একটা জরুরী মিটিং পড়ে গেছে রাতের দিকে। মিটিং কখন শেষ হবে জানি না। অনেক নামি চিকিৎসা-বিজ্ঞানী উপস্থিত থাকবেন।এর বেশি বলা যাবে না , কাল বাড়ি গিয়ে সব বলবো। পলাকেও মোবাইলে জানিয়ে দিয়েছি , ও আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যাবে।” ফোনটা কেটে গেল। মিসেস মালদিনি বেশ চিন্তিত মুখে চেয়ারে এসে বসলেন। মিষ্টার মালদিনি জিজ্ঞেস করলেন,” পিটের কি কোন সমস্যা হয়েছে?”
মিসেস বললেন,”পিটের নয়, কোনো বড়ো কিছু ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে মনে হচ্ছে।”
পরের দিন রাতে পিট তখন বাড়ি এলো ওর মুখে দু্শ্চিন্তার‌ কালো মেঘ। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিঙ টেবিলে বসার পর ও কেউ ওকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না, এমন কি বাচ্ছা দুটো পর্যন্ত। খাওয়া শেষ করে পিট মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”চিনে এক অজানা ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছে। ওখানকার একটা প্রদেশে একসাথে কয়েক হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে মাত্র দশ দিনের মধ্যে। অনেক লোক মারা গেছে। রোগটা ফ্লুয়ের মতো, কিন্তু ফ্লু -র থেকে এর মারণ‌ ক্ষমতা বহুগুণ বেশি। আমাদের কালকের জরুরী মিটিং ছিল এই নতুন ভাইরাস বিষয়ে। সরকারী হোমরা-চোমরা তারা এসেছিলেন তাঁরা এটাকে ফ্লু বলে উড়িয়ে দিলেন। ওদের কথায় ইটালীর চিকিৎসা পরিকাঠামো যেখানে এতো উন্নত সেখানে একটা ফ্লু নিয়ে এতো চিন্তা করার কি আছে? আমি ও আর একজন চিকিৎসক বার বার ওনাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এই ব্যাপারে মিলে না দিয়ে এখনি তিন সরকারের কাছ থেকে তথ্য চেয়ে পাঠানো হোক, ওনারা হেসে আমাকে থামিয়ে দিলেন। তবে মা তোমার কি মনে‌ হচ্ছে না যে সরকারী প্রশাসনের এই হঠকারিতার খেসারত একদিন গোটা দেশকে দিতে হবে। ভুললে চলবে না ব্যবসা ও চাকরি সূত্রে বহু চিনা ইটালীতে বাস করে।”
কদিন পর পিট উত্তেজিত হয়ে হসপিটাল থেকে ফিরল ।
” বড়ো বড়ো চেয়ারে বসে থাকা লোকগুলো এবার দেশকে শেষ করে দেবে।”

” কেন কি হয়েছে?” জিজ্ঞেস করল পলা।”
” পলা তুমি তো জীবাণু নিয়ে কাজ করো, ভাইরাস সম্বন্ধে তোমার ভালোই ধারণা আছে। আচ্ছা বলো তো পৃথিবীতে মহামারি শেষ কবে এসেছিল ?

পারলে না তো, ১৯২০ সালে। কিছু দিনের মধ্যেই এই নতুন ভাইরাস করোনারি জন্য একশো বছরের মাথায় আবার পৃথিবীতে মহামারি আস্তে চলেছে । আর আমাদের মাথামোটা আমলারা নাকে সর্ষের তেল দিয়ে এখন ঘুমোচ্ছে। ওরা বলছে সুদূর চিন থেকে এতোদূর ওসব আসবেই না । দেখছেন চিনের পাশের দেশগুলোতেই কোনো হেলদোল নেই। ওটা ঐ ইউহানে শুরু হয়েছে, ওখানেই শেষ হয়ে যাবে। কিছুতেই ওদের বোঝাতে পারলাম না আমাদের এখন ই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।”

মাস দুয়েক কেটে গেছে । জার্মানি, ইটালী, ফ্রান্স এখন নতুন ভাইরাসের কবলে। পিটের দেশে হু হু করে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে , পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মৃত্যুর সঙখ্যা । সরকার সারা দেশে লক ডাউন ঘোষণা করলো। কিন্তু আড্ডাবাজেরা হেসে লক ডাউনকে উৎসবে পরিণত করলো। অল্প সময়েই ইটালি রোগের স্টেজ থ্রীতে পৌঁছে গেল। পলা বাড়িতে ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভাল করছে। পিট বাড়ি আসার সুযোগ ই পাচ্ছে না । হাসপাতাল গুলোতে রাশি রাশি রোগী ঢুকছে আর কদিন পর অনেকে মারা যাচ্ছে। নেই সঠিক ওষুধ , আপ্রাণ চেষ্টা করেও ডাক্তাররা মৃত্যু মিছিল আটকাতে পারছে না। পিটের মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তো নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। করোনা রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তারদের কয়েকজন নিজেরাই আক্রান্ত। এর মধ্যে ছজন ডাক্তারের এই রোগে মৃত্যু হলো এক সপ্তাহের মধ্যে।পলা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো পিটের জন্য। গোটা দেশে এক অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী জরুরী অবস্থা জারি করে সারা বিশ্বের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। টিভিতেই প্রধানমন্ত্রী হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। পলার আতঙ্ক বেড়ে গেল।
গত তিনদিন পিটের কোনো খবর নেই। বাড়িতে পাঁচটি প্রাণীর আহার-নিদ্রার পাট চুকে গেছে। চতুর্থ দিন সকালে পিট ফোনে জানালো ,” পলা , আমি করোনায় আক্রান্ত। মে কোনো মুহূর্তে প্রাণ চলে যাবে।
শেষবারের মতো বাবা-মাকে, তোমাকে আর আমার ছোট্ট সোনামণিদের দেখতে চাই। তাই আজ বিকেলে যাব। ঠিক পাঁচ টায় । তোমরা ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িও। আমি বাড়িতে ঢুকবো না।সদর দরজাটা খুলে রেখ, আমি ওখান থেকেই তোমাদের দেখে চলে আসবো। ”
নির্দিষ্ট সময়ে হাসপাতালের একটা কালো ভ্যান এসে দাঁড়ালো সদর দরজার সামনে। তিনজন আপাদমস্তক পিপিই , মাস্ক, গ্লাভস পরা লোক নেমে এলো গাড়ি থেকে। দুজন গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে রইল ।একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তি শুধু এগিয়ে এসে খোলা সদর দরজা জূড়ে দাঁড়ালো। কয়েক মিনিট বাড়ির ভিতরে দাঁড়ানো মানুষগুলোর দিকে চেয়ে রইল।তারপর ওদের দিকে একবার হাতটা নাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে গাড়িটাতে উঠে পড়লো।
ঠুকরে কেঁদে উঠলো পলা। ছোট্ট ছেলে-মেয়ে দুটো মাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞ্যেস করলো ,” মা, বাবা আর আসবে না?”

শুভেন্দু কুমার চট্টোপাধ্যায়
বালি, হাওড়া ,ভারত।


আরও পড়ুন:

Follow Bangla Live on Facebook

Follow Bangla Live on YouTube