+91 9330828434 +91 9804424251 banglalivenews@gmail.com

ঈশান কোণের দোষ – গল্প – হেমন্ত জানা

হেমন্ত জানা - July 13, 2022 11:11 am - সাহিত্য

ঈশান কোণের দোষ – গল্প – হেমন্ত জানা

মিত্রা নাম দিল মায়াঘর। ঘরের ইটের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের মায়া লেগে। সিমেন্ট–বালি নয়, আমাদের মায়া দিয়ে গাঁথা এই ঘর। নইলে আমি ভেবেছিলাম নাম রাখব ‘‌স্বপ্নপুরী’‌। মিত্রা বলল, ‘‌এঘর তোমার–আমার মায়া জড়ানো। কত স্বপ্নই তো আমরা দেখি। সেই স্বপ্ন সার্থক করতে মায়া লাগে। ঘোর মায়া!‌’‌ মিত্রার যুক্তি আমার মনে ধরে। তাই ওর দেওয়া‌ নামটাই থাকল। বাড়ির সামনে সোনার বর্ণে জ্বলজ্বল করছে ‘‌মায়াঘর’‌। আসতে–যেতে তাতে চোখ পড়লেই মনটা অহঙ্কারে ভরে যায়। কত কষ্টের এই ঘর আমাদের। শহরের বুকে জায়গা কিনে বাড়ি করা এ–বাজারে চাট্টিখানি কথা নয়!‌ বিয়ের পর দশটা বছর এই বাড়ির জন্য আমরা রীতিমতো লড়াই করেছি। আমার প্রাইভেট ফার্মের পনেরো হাজারি চাকরি। অফিস থেকে ফিরেও একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করেছি। মিত্রার সেলাই, টিউশন পড়ানো। দু–বেলা সাদামাটা খেয়েছি। একই পোশাক পরে দিনের পর দিন অফিস করেছি। এই দশ বছরে মিত্রা একটা শাড়ি পর্যন্ত কেনেনি। বিয়েতে যা পেয়েছিল তা দিয়েই চালিয়ে নিল। আর খরচের ভয়ে তৃতীয় জনকেও সংসারে আনতে পারিনি। তিল তিল করে জমানো পয়সায় আমাদের এই বাড়ি। মিত্রা ঠিকই বলেছে মায়া না থাকলে স্বপ্ন পূরণ হয় না।

নরেন্দ্রপুরের ভাড়া ঘর ছেড়ে পঞ্চসায়রে আমাদের মায়াঘরে এসেছি গত মার্চের ১৩ তারিখ। সুখে সুখে কোথা দিয়ে বছরটা ঘুরে গেল। আগের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে এখানে এসে যেন দু–জনেই জোরে জোরে বাতাস টেনে ফুসফুসে ঢোকাচ্ছি। কী স্বস্তি কি স্বস্তি!‌ খাই না খাই অফিস করে এসে আমাদের শান্তির নীড়ে ঢুকলেই সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। চিন্তা–পরিশ্রমে কাঠ হয়ে যাওয়া মিত্রার শরীরও নতুন পরিবেশে চৈত্র–বোশেখের বট–অশ্বত্থের মতো নতুন পাতা মিলছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ি। মিত্রাকে অনেকক্ষণ আদর করি। আর দেরি করতে চাই না। আমাদের মায়াঘরে এবার আনতে চাই একটা মায়ার পুত্তুলি। মিত্রা আবার সেলাইয়ের কাজ শুরু করতে চেয়েছিল, আমি করতে দিইনি। বলি, অনেক খেটেছো এবার একটু জিরোও। বাড়ির সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা রেখেছি। সেখানে সবজি ফলায় মিত্রা। আমি বসিয়েছি রজনীগন্ধ, জবা, টগরের গাছ। ছুটির দিনে আমার তাদের নিয়ে ভালই কাটে। সেদিন গাছের পরিচর্যা করছি, মিত্রা কানে মুখ নিয়ে এসে খুশির খবরটা শোনাল। আমি আনন্দে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছি ও হাত ছিনিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। আমাদের মায়াঘরে যেন আনন্দের বান আছড়ে পড়ল। কাজ ফেলে ঘরে ঢুকে মিত্রাকে জড়িয়ে ধরলাম। কানের লতিটা ঠোঁট দিয়ে আলতো চাপ দিয়ে বললাম, ‘‌মেয়ে হলে নাম রাখব টগর। তুমি যখন খবরটা দিলে তখন আমি টগর গাছে জল দিচ্ছি। ছেলে হলে তুমি নাম রেখো। তুমি সেটা ভেবে রেখো।’‌

আমাদের মায়াঘর হাসি–খুশিতে উপচে পড়ছে। যেন সেই প্রচণ্ড গরমের মাসগুলো পেরিয়ে আকাশ কালো করে আষাঢ়ের বৃষ্টি নেমেছে ঝেঁপে, শুকনো মাটিতে জল পেয়ে সোঁদা গন্ধ উঠেছে। যেন ঠিক সেই পরিবেশটা, চারপাশ সবুজে সবুজে ভরে গেছে। নদী–নালার শুকনো বুকে স্রোত বইছে। মাছেরা মিলনে মত্ত। আমাদের প্রতিটা ক্ষণে এখন সেই আষাঢ়ের আনন্দ। সেই আনন্দে আনন্দে কোথা দিয়ে মাস তিনেক কেটে গেল। সেদিন আবার আমি গাছের চর্চা করছি। ঘরে কিছু পড়ার শব্দ কানে এল। ছুটে গিয়ে দেখি বাথরুম থেকে মিত্রার চিৎকার আসছে। ভেতর থেকে বন্ধ। ধাক্কা দিয়ে ফাইবারে দরজা ভেঙে মিত্রাকে কোলে তুলে বাইরে আনলাম। রক্তে ভেসে যাচ্ছে কাপড়–চোপড়। বুঝলাম সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। ডাক্তার এসেও তাই বললেন। আমাদের মায়াঘরে সেদিন প্রথম কষ্ট ঢুকল। মিত্রা অনবরত কাঁদে। আমার ভেতরটাও ভেঙে গেছে। তবুও সান্ত্বনা দিই। ঝেড়ে উঠে আবার সংসারের কাছ করে মিত্রা। আমি অফিস করি। অফিস থেকে ফিরে আর সেই উচ্ছ্বল আনন্দ নেই।

আমার অনেক দিনের সখ ছিল বদ্রি পাখি পোষার। মন মরা মিত্রাকে ভোলাতে কয়েকটা বদ্রি পাখি আনি। ছাদে জাল দিয়ে তাদের ছোট একটা ঘর বানিয়ে দিয়েছি। তাদের ভার মিত্রার ওপরই ছেড়ে দিয়েছি। পাখির সঙ্গে সময় কাটে ওর। মাস খানেক পর হঠাৎ আটটা পাখির একটা মারা গেল। এমন তো হয়েই থাকে। তাকে গুরুত্ব দিইনি। তার কয়েকদিন পর আরও দুটো। এবার মিত্রার ভাঙা মনে তা মৃদু আঘাত করে। অফিসের এক কলিগ পাখিগুলো দিয়েছিল। তাকে বলতে বলল, ‘‌বদ্রি পাখি সাধারণত চট করে মরে না। কয়েকটা ছোটখাটো পরামর্শ দিল। তা মিত্রাকেও বলে দিলাম। অক্ষরে অক্ষরে মেনেও রক্ষা করা গেল না বাকিদের। মাস দুয়ের মধ্যে খাঁচা শূন্য হয়ে গেল। মিত্রার এবার ভয় ধরল। ভাবল এর জন্য দায়ী অশুভ কিছু। আমি সেসবকে পাত্তা দিইনি। আর আমাকেও সে পাত্তা না দিয়ে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলল। সেদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি মিত্রা ভয় ভয় মুখে বসে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করি। বলে, ‘‌গ্যাস লিক করছে। রান্না বন্ধ রেখেছে।’‌ আমি ভাল করে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করে তেমন কিছুই দেখতে পেলাম না। আমিই ফেলে রাখা রান্না ফের শুরু করলাম।

ঠিক এর দুদিন পর। দুপুর দেড়টা হবে। অফিসে আছি। মিত্রার ফোন। আর্ত চিৎকার—সর্বনাশ হয়ে গেছে, গ্যাস লিক করে আগুন ধরে গেছে।’‌ ‘‌তুমি কোথায় আছো?‌ ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসো। ‌দমকলে ফোন করছি।’ বলে‌ সব কাজ ফেলে ছুটে আসি। দমকল আসার আগেই আশপাশের লোকজন আগুন নিভিয়ে দেয়। মিত্রা আতঙ্কে আর ঘরে ঢুকতে চায় না। আমার ওপরেই দায় চাপে, সেদিন যদি গ্যাসের অফিসে ফোন করে একবার দেখিয়ে নিতাম তাহলে এই সমস্যা হত না। মিত্রাকে বলি, ‘‌আমারই ভুল। সেদিন ইমারজেন্সিতে ফোন করে দেখিয়ে নিলেই হত। যাক তুমি বুদ্ধি করে বেরিয়ে এসে আশপাশের লোকজন জড়ো করতে পেরেছিলে বলেই বাঁচোয়া। তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। শুধু চিমনিটা পুড়ে গেছে। সেটা বদলাতে হবে। খেয়াল করি মিত্রার মনে এবার জাঁকিয়ে বসছে ভয়। আমি যতক্ষণ থাকি মেয়েটার মুখে তবুও হাসি দেখি, বেরিয়ে গেলে মুখটা কালো হয়ে যায়। বুঝতে পারি মিত্রা আর একা থাকতে পারছে না। কিন্তু অফিস তো যেতেই হবে।
রবিবার ছুটির দিন। বাজার–দোকান থাকে। সেসব করে খেতে দেরি হয়। ভাল–মন্দ রান্নাও হয়। বসে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করতে করতে খাই। ডায়নিংয়ে গরম মাংসের ঝোলটা সবে রেখেছি। মিত্রা থালায় ভাত বাড়ছে। সিলিং থেকে ঝোলে পড়ল রমণরত দুটি টিকিটিকি। ছটফট করতে করতে তারা মারা গেল। মিত্রা আঁতকে উঠল। আমারও মনটা খারাপ হয়ে গেল। একের পর এক ঘটনা আর স্নায়ুর জোর ধরে রাখতে পারছি না। ভেতরে ভেতরে ভাঙছি, কিন্তু বাইরে বুঝতে দিইনি। তাহলে মেয়েটাকে আর মায়াঘরে রাখা যাবে না!‌ আমি অফিস গেলে তাকে সঙ্গ দেওয়ার মতো কোনও কাজের মেয়েকে রাখার মতোও আমার আর্থিক ক্ষমতাও নেই। মিত্রা একদিন বলল, ‘‌দুপুরের দিকে আমাদের বাথরুমে একটা কালো রঙের পাখি মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ে।’‌ বললাম, ‘‌যেখানটা দিয়ে ঢোকে বন্ধ রাখলেই তো হল।’‌ মিত্রা বলে, ‘‌সব সময় কী খেয়াল থাকে!’‌‌ মেয়ের ভয় কাটাতে কয়েকদিন মিত্রার মাকে এনে রাখলাম। মাকে পেয়ে মেয়ে বেশ হাসি খুশিতে আছে। সেই সুযোগে আমাদের সংসারে আরেকজন ঢুকে পড়েছে। শাশুড়ি মাকে বলি, ‘‌এসময় আপনি আরও কয়েকটা দিন থেকে যান।’‌ শাশুড়ি মা থেকে গেলেন আরও মাস দুয়েক। কিন্তু এই সময় আর মিত্রাকে একা রাখতে চাইনি। পাশের রেল কোলনি থেকে একটা বছর বারোর মেয়েকে পেয়েছি। নাম ফুলি। সে সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত থাকবে। খাওয়া–দাওয়া আর হাজার টাকা দিতে হবে। শুধু সঙ্গ দেবে কাজ কিছু করতে হবে না। মাস ছয়েক হয়ে গেলে মিত্রার মা আবার এসে থাকবেন।

ফুলি দিন পনেরো সবে আসছে। মেয়েটা খুব সাহসী। কোথাও কিছু শব্দ হলে মিত্রা শিউরে ওঠে। কিন্তু মেয়েটা একাই দেখতে যায়। অফিসে কাজের ফাঁকে বাড়িতে তিন–চারবার ফোন করি। মিত্রা হয়তো কাজে ব্যস্ত, ফোন করেছি, মেয়েটা ফোন ধরে। সেদিন দুপুরে মিত্রার নম্বর থেকে ফোন, ঘরপোড়া গরুর মতো আঁতকে উঠি। মেয়েটা বলে, ‘‌বৌদি কেমন করছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো দাদা।’‌ কীভাবে যে পার্কস্ট্রিট থেকে পঞ্চসায়ের এলাম আমার কোনও স্মৃতি নেই। দেখি মিত্রা শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তাড়াতাড়ি নার্সিংহোমে নিয়ে গেলাম। যেটা ভয় করছিলাম সেটাই হল। আর মিত্রাকে কি বলে সান্ত্বনা দেব। আমি নিজেকেই সান্ত্বনা দিতে পারছি না। মিত্রাকে নার্সিংহোম থেকে ওর মা নিয়ে চলে গেলেন। আমি পড়ে রইলাম পঞ্চসায়রের আমাদের মায়াঘরে।

অফিস যেতে ভাল লাগছে না। একাই মন খারাপ করে ঘরে পড়ে থাকি। আমাকে সান্ত্বনা দিতে একদিন অফিসের অপূর্ব এল। নতুন বাড়িতে সেই কোনও অফিস কলিগের পা পড়ল। তাকে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাই। অপূর্ব বলে, ‘‌তোর বাড়িতে দোষ আছে ভাই। বাস্তুশাস্ত্র বিরোধী অনেক কিছুই দেখছি।’‌ আমি বলি, ‘‌বড় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নকশা করে দিয়েছে রে।’‌ অপূর্ব তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ‘‌ওরা বাস্তুশাস্ত্রের কী জানে!‌ ওরা এসব মানেও না।’‌ আমি বলি, ‘‌তুই জানলি কি করে?‌’‌ অপূর্ব বলে, ‘‌আমার শালার শ্বশুর বড় জ্যোতিষী। মাঝে মাঝে তঁার শরণাপন্ন হই। ‌আমার বাড়ি তৈরির সময় তিনি কিছু নিয়মকানুন বলেছিলেন। সেগুলিই দেখছি তোর বাড়িতে সব উল্টো। সিঁড়ি অ্যান্টি ক্লকওয়াইজ, বাথরুম, কিচেন ঘোরতর বাস্তুশাস্ত্র বিরোধী। তোর সংসারের এত কিছুর মূলে তোর এই নতুন বাড়িই।’‌ চমকে উঠি আমি, ‘‌কি বলছিস অপূর্ব, এ মায়াঘর শুধু চকটধারী নাম নয়, এর প্রতি বালুকণায় মিত্রার আমার মায়া মেশানো আছে। শহরের বুকে জায়গা কিনে বাড়ি, তা ওই মাইনের টাকায় কি সম্ভব!‌ তোরা জানিস না, জানতে চেষ্টাও করিসনি। আবডালে বলেছিস, শ্বশুরবাড়ির টাকায় নাকি বাড়ি করছি। আমার শ্বশুরমশাইয়ের সেই সামর্থ নেই রে।’ অপূর্ব বলে,‌ ‘‌থাক সেসব কথা। যদি এই বাড়িতে থাকতে চাস দোষ কাটা।’‌ বলি, ‘‌আমি কোনও কালে এসব মানিনি অপূর্ব। খোলা মনে মানুষ হয়েছি। এসবকে পাত্তাই দিইনি।’‌ অপূর্ব বলে, ‘‌পাত্তা দিসনি বলেই তো বলিনি। বাড়ি তৈরির কথা যখন বললি, এসব বলতেই পারতাম, জানি বললেও তুই মানবি না। উল্টে আমাকে অফিসে গেঁয়ো ভূত বলে তাচ্ছিল্য করবি।’‌ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি, ‘‌আর স্নায়ুর জোর রাখতে পারছি না। দু–দুবার মিত্রার মিসক্যারেজ হয়ে গেল। ও আর এখানে আসতেই চাইছে না।’‌ অপূর্ব বলে, ‘‌তুই যদি বলিস, তাহলে আমার শালার শ্বশুরকে একদিন আসতে বলি। যা বলবেন সেই মতো হবে।’‌ অপূর্ব চলে গেল।

তারপর থেকে আমারও ভয় ভয় করছে। অফিস যাই, ফিরে নানা চিন্তায় রাত কাটে। কোথাও একটু সামান্য শব্দ হলেই বুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে। কত মায়ার ঘর, তার মধ্যে এত দোষ বাসা বেঁধে আছে! ভাবতেই পারি না। যদি জ্যোতিষ বলে, এঘরের মায়া ত্যাগ করতে হবে, তাহলে কোথায় যাব আমরা!‌ আর জায়গা কিনে ঘর করতে পারব না। এই বাড়ি নিয়ে এলাকায় যা রটে আছে কেউ সহজে কিনতেও চাইবে না। চিন্তা করে করে রক্তচাপ বাড়ে। মাথা ঘোরে। বসে থেকে উঠতে গেলে অন্ধকার দেখি। একটু চিৎকার, কারও কান্না শুনলেই বুকটা ধড়ফর করে। মাসখানেক আমি তো একাই আছি কোনও কিছু অস্বাভাবিক আমার নজরে পড়েনি। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কোনও বিদঘুটে শব্দও কানে আসেনি। তাহলে এর আবার দোষ কোথায়!‌ অপূর্ব ফোন করেছিল। আগামী রবিবার ওর শালার শ্বশুরমশাইকে নিয়ে আসছে। আমার ভয়, যদি বলেন, এবাড়িতে থাকা যাবে না, তাহলে কি করব। আর সবকিছু তুড়ি মেরে অগ্রাহ্য করে এখানে থাকার মতো দেহ–মনের শক্তি নেই। মিত্রাকেই বা রাখব কেমন করে!‌

অপূর্বর শালার শ্বশুরমশাই বাড়ির চারপাশটা আগে ঘুরে দেখলেন। তারপর বাড়ির ভেতরে এলেন। ছাদে গেলেন। ছাদ থেকে ওপর নীচ সব দেখলেন। এবার বাড়ির দোষ ত্রুটি বলবেন, বুকটা দুরদুর করছে। চা করে দিয়েছি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুরু করলেন, ‘‌বাড়ির ছোটখাটো অনেক দোষ আছে বাবা। তবে সেগুলি তেমন কিছু নয়, সব বাড়িতেই কম বেশি থাকে। এবাজারে অতকিছু মেনে বাড়ি করা যায় না। ছোট জায়গায় মানিয়ে নিয়ে ঘর করতে হয়। তবে বাবা তোমার বাড়ির মস্ত বড় দোষ ঈশান কোণের শৌচালয়। সেপটিক ট্যাঙ্কটাও একেবার বাবা শিবের মাথার ওপর। জানো শিবের আরেক নাম ঈশান। বাস্তুর ঈশান কোণে তাঁর অধিষ্ঠান। বাবার মাথায় যদি তোমরা বাহ্য ত্যাগ করো, সেটা কী ভাল দেখায় বলো। বাস্তুশাস্ত্রের মতে এই কোণে শৌচালয় করলে বংশ লোপ হয়। তোমার সংসারে নতুন কেউ আসতে পারছে না এ জন্যই। শৌচালয় ওখানে থাকলে ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতি হতে পারে। ওর পাশেই আছে রান্নাঘর, সেটাও ঘোর বাস্তুশাস্ত্র বিরোধী। এই দুটো আপাতত সরালেই বাড়ি বসবাসের উপোযোগী হবে। সিঁড়িতেও ত্রুটি আছে। সাবধানে ওঠানামা করলেই হবে। এবার বলি, এগুলো সরিয়ে কোনদিকে করতে হবে। বাড়িটা যেহেতু পূর্ব–পশ্চিমে লম্বালম্বি। পশ্চিমমুখো প্রধান দরজা। শৌচালয়কে সরিয়ে আনতে হবে দক্ষিণ পশ্চিম কোণে। রান্নাঘর সরিয়ে আনতে হবে ওদিকে মানে দক্ষিণ–পূর্ব কোণটায়। আর তোমার এখনের শৌচালয়টা মানে বাথরুমটা ভেঙে সুন্দর করে ঠাকুরঘর করো। পাশের রান্নাঘর আর ভাঙতে হবে না, ওঠা ভাঁড়ারঘর হিসেবে ব্যবহার করতে পারো। আপাতত এগুলো ঠিক করলেই তোমার বংশ রক্ষা হবে। যারা চলে গেছে মায়ের কোল আলো করে আবার ফিরে আসবে তারা।

জ্যোতিষীর কথা মেনে ওই ঈশান কোণ থেকে সরালাম বাথরুম। পাশের কিচেনকে সরিয়ে নিয়ে এলাম ডায়নিংয়ের কিছুটা জায়গা ঘিরে। আগের বাথরুম ভেঙে নতুন করে টালি–পাথর বিছিয়ে ঠাকুরঘর বানালাম। সেখানে বাবা মহেশ্বরকে প্রতিষ্ঠা করলাম। সেদিন মিত্রা বাপের বাড়ি থেকে আবার মায়াঘরে ফিরে এল। অপূর্বর শালার শ্বশুরমশাই আরেকদিন এসে সব দেখে গেলেন। মিত্রাকে সাহস দিয়ে বলে গেলেন, ‘‌আর তোমার কোনও ভয় নেই মা। নির্ভয়ে সংসার করো। অজান্তে বড় ভুল করে ফেলেছিলে। অল্পতেই ঈশানদেবের রাগ গলে জল হয়ে যায়। আর তোমাদের কোনও ক্ষতি হবে না। মায়া দিয়ে তাকে ডাকো। মায়াজালেই বদ্ধ তিনি। এবার তোমরাই তার মায়ায় জড়িয়ে যাবে।’‌

যতই জ্যোতিষী সাহস দিয়ে যান, বিশ্বাস করবেন না ওই দশমাস মিত্রা–আমার খুব ভয়ে ভয়ে কেটেছে। মিত্রার একটু পেট ব্যাথা করলেই বুকের ভেতরটা থরথর করে কেঁপে উঠেছে। মিত্রার মা ওই দশ মাস মেয়েকে বুকে আগলে আমাদের সংসারে পড়ে থেকেছেন। ঈশানদেবকে আমরা মনপ্রাণ দিয়ে ডেকে গেছি। সত্যিই তিনি আশুতোষ, মুখ রক্ষা করেছেন। আমাদের মায়াঘর আলো করে এসেছে এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান। মিত্রা নাম রেখেছে ঈশান।


আরও পড়ুন:

Follow Bangla Live on Facebook

Follow Bangla Live on YouTube