না ফেরার দেশে চলে গেলেন চলচ্চিত্র পরিচালক…বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
পুরুলিয়ার আনারা তে জন্ম ১৯৪৪ সালের ১১ই ফ্রেব্রুয়ারি। বাবা তারাপদ দাশগুপ্ত ছিলেন রেলের ডাক্তার। .যাত্রাপথের চর্যাপদে জড়িয়ে ছিল রেলগাড়ি।বাবার কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে তাঁর শৈশব ও কিশোরবেলা। বারো বছর বয়সে চলে আসেন হাওড়ায়। হাওড়ার প্রজ্ঞানানন্দ স্কুলে পন্চম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে দীনবন্ধু স্কুলের প্রাক্তনী। কলেজ জীবনে অর্থনীতি নিয়ে স্কটিশ চার্চে এবং উচ্চ শিক্ষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।বুদ্ধদেব বাবুর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল অধ্যাপনা দিয়ে। প্রথমে অধ্যাপক ছিলেন.. সিটি কলেজের,তারপর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্যামসুন্দর কলেজ। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পুঁথিগত অর্থনীতির তত্ত্ব ও বাস্তবের ছবির আকাশ-পাতাল পার্থক্য তাঁর কাছে পীড়াজনক হয়ে উঠল। তিনি বেছে নিলেন চলচ্চিত্র পরিচালনাকে। তবে সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল স্কুল জীবন থেকেই। কাকার সূত্রে সদস্য হয়েছিলেন ক্যালক্যাটা ফিল্ম সোসাইটির। ঘাসের মাঝে লালপোকা থেকে ঝুমুরনাচ, রাঢ় বঙ্গে কাটানো শৈশব তাঁর ছবির অনুঘটক ছিল।শিকড়ে ফিরে গেলে বুদ্ধদেব দাসগুপ্তের পরিচালক জীবন শুরু হয়েছিল পুরুলিয়ার রুক্ষ মাটিতে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবির সেই ভবঘুরেরা অমর ৷ দিবাস্বপ্ন হলেও তারা দিন পাল্টানোর প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করতে ভালবাসে ৷
একে একে পরিচয় হল চ্যাপলিন, বার্গম্যান, কুরোসাওয়া, ডি সিকা, রোসেল্লিনি, অ্যান্তোনিওনির সৃষ্টির সঙ্গে ৷ সেলুলয়েডের মাধ্যমে জীবনদর্শনই হয়ে উঠল তাঁর উপজীব্য৷
ক্যামেরা, লাইট, সাউন্ডের পর্ব শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালে, দশ মিনিটের তথ্যচিত্র ‘কন্টিনেন্ট অব লভ’ দিয়ে ৷ তার পর স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘সময়ের কাছে’৷ পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি আরও ১০ বছর পর ৷ ১৯৭৮-এ মুক্তি পেল ‘দূরত্ব’ ৷ এর পর ‘নিম অন্নপূর্ণা’, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘অন্ধি গলি’, ‘ফেরা’, ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘তাহাদের কথা’, ‘চরাচর’, ‘লাল দরজা’, ‘উত্তরা’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘স্বপ্নের দিন’, ‘আমি ইয়াসমিন আর আমার মধুমালা’, ‘কালপুরুষ’, ‘আনওয়ার কা আজব কিস্যা’—অজস্র অলঙ্কারে সাজিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রকে ৷ তাঁর তথ্যচিত্রের মধ্যে ভাস্বর হয়ে আছে ‘শরৎচন্দ্র’, ‘রিদম অব স্টিল’, ‘বিজ্ঞান ও তার আবিষ্কার’, ‘সেরামিক্স’ এবং ‘আরণ্যক’৷
অসংখ্য পুরস্কারে বার বার ভূষিত হয়েছে তাঁর কাজ ৷ শ্রেষ্ঠ ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে সম্মানিত হয়েছে ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘চরাচর’, ‘লাল দরজা’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ এবং ‘কালপুরুষ’ ৷ ‘উত্তরা’ ও ‘স্বপ্নের দিন’ পেয়েছে শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার ৷ অন্যান্য বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে তাঁর ‘ফেরা’, ‘দূরত্ব’ এবং ‘তাহাদের কথা’৷ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ভূষিত হয়েছে ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘চরাচর’, ‘উত্তরা’, ‘নিম অন্নপূ্র্ণা’, ‘জানালা’ এবং ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ ৷
নাগরিক জীবনের বাইরে, বাঙালিয়ানার চেনাবৃত্ত পেরিয়ে তাঁর ছবিতে ধরা দিয়েছে লোকজ সংস্কৃতি। ৷ রাঢ় বঙ্গে কাটানো শৈশব তাঁকে কোনওদিন ছেড়ে যায়নি ৷ ছোটবেলার কোলাজ ছবি ফিরে ফিরে এসেছে ‘বাঘ বাহাদুর’-এর লোকনৃত্য এবং ‘উত্তরা’-র ঝুমুরে ৷ ছোটবেলায় খড়্গপুর রেলস্টেশন লাগোয়া মাঠে ঘাসের মাঝে লালপোকাদের নিয়ে খেলা ছিল তাঁর সৃষ্টির অনুষঙ্গ ৷
অতিমারিতে আটকে গিয়েছিল পরবর্তী পরিকল্পনা ৷ ইচ্ছে থাকলেও করা হয়ে ওঠেনি জীবনানন্দ দাশ এবং তাঁর নিজের কবিতা থেকে ছবি ৷ বিশ্বাস করতেন সিঙ্গলস্ক্রিন হলগুলির অপমৃত্যু আদতে বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে অশনিসঙ্কেত ৷ তবে পরিচালকদেরও একদিন থামতে হয় ৷ অবসর নিতে হয় ৷ এই ধারণা তাঁর মনে বলিষ্ঠ ছিল। ৷
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মামা সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত কাছে। অন্তর্জলী নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনাও একসময় শুরু করেছিলেন তিনি। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে সখ্য ছিল তাঁর। কবি ভাস্কর চক্রবর্তী, সামশের আনোয়াররা ছিলেন তাঁর আত্মার আত্মীয়। বন্ধু ফাল্গুনী রায়ের লেখা কবিতা আউরাতেন, “মানুষ বেঁচে থাকে, মানুষ মরে যায়/ কাহার তাহাতে ক্ষতি? কিই বা ক্ষতি হয়? আমার শুধু বুকে গোপনে জ্বর বাড়ে. মানুষ বেঁচে থাকে মানুষ মরে যায়।” তাঁর অগুনতি ভক্তদের মনে বারবার ফিরে আসছে এই কবিতার লাইনগুলো বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর কাছে তাঁর পরিচালক পরিচয়ের থেকেও আপন ছিল কবি সত্ত্বা ৷ কবিতার মৃত্যু নেই ৷ অমর তাঁর ছবির সেই ভবঘুরেরাও ৷ দিবাস্বপ্ন হলেও তারা দিন পাল্টানোর প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করতে ভালবাসে ৷ ‘চরাচর’-এর লখিন্দর একদিন নিজেই পাখি হয়ে আকাশে ডানা মেলে ৷।