প্লাটফর্ম – গল্প
প্লাটফর্ম
আর পাঁচটা ভিখিরি, ভবঘূরের মতো প্লাটফর্মেই আস্থানা মণিদীপার।তবে অন্যান্যদের থেকে সে একটু
আলাদা। অনেকটা সে মানবিক সচেতন ও বটে। সুন্দর গানের গলা , পড়াশোনা ও জানে এ হেন একজন মানুষ কেন যে এভাবে ঐ পাগল ভবঘুরেদের মাঝে এই জায়গায় তা অনেকের কাছেই অজানা কৌতূহলের ও। কম বেশি সবাই চেনে তাকে।সেই ই ঐসব পাগল, ভবঘুরে, ভিখিরিদের অভিভাবক।সবার দিদি।
অন্যান্য দিনের মতো সেদিন ও মানা, ঝর্না,গোকুল, গীতা সহ সবাই অপেক্ষায় ছিল কখন তাদের দিদি আসবে। খাবার জুটছে না, তার ওপর লকডাউন। ট্রেন বন্ধ, যাত্রী নেই হাত পাতলে কে আর ভিক্ষে দেবে! শুনশান প্লাটফর্ম।এরই মাঝে ঝর্না চিৎকার করে বলে ওঠে ঐ তো , দিদি আসছে।
মণিদীপা বলে তোরা সবাই এসে গেছিস!
সমস্বরে সবাই বলে ওঠে হাঁ দিদি।
এরপর ঝর্ণা বলে, আজ আর দিদি পড়তে টড়তে বোলো না , সকাল থেকে আজ আমাদের কিছুই খাওয়া হয়নি।
সে কিরে! আজ কেউ কিছু দিতে আসে নি।কি আর করা যাবে , এই নে , যা পেয়েছি সবাই মিলে ভাগ করে খাই।আজ কটা পাউরুটি , মুড়ি বিস্কুট। নে খেতে শুরু কর।
দাও দিদি খুব খিদে পেয়েছে, গোকুল বলে।
মণিদীপা সবাইকে ভাগ করে দিয়ে নিজেও খায়।
খেতে খেতে মানা বলে আজ কতদূর গিয়েছিলে দিদি?
মণিদীপা বলে, আজ বেশি দুর যেতে পারি নি। রতনপুর ঘাটেই ছিলুম। লোকজন তেমন নেই, ওখানেই বসে গাইলাম দু কলি।
আজ কোন গানটা গাইলে গো দিদি? সেই সুন্দর গানটা । মানা জানতে চায়।
মণিদীপা বলে ওঠে হাঁ রে তোর সেই সুন্দর গানটাই।
আমায় নহে গো ভালোবাসো তুমি , ভালোবাসো মোর গান। ঘাটে যে কটা খেয়া ভিড়েছে, বাটি পেতে গেয়েছি এই গানটাই ।
মণিদীপাএকটা চাপা শ্বাস ফেলে বলে কবে যে লকডাউন উঠবে ।
গোকুল বলতে শুরু করে যা বলেছো দিদি, প্লাটফর্মে ট্রেন নেই , লোকজন নেই, তাই ভিক্ষেও নেই ।ছ মাস পার হয়ে বছর পড়তে গেল। প্রথম প্রথম কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে খিচুড়ি , ভাতের প্যাকেট, রান্না করা খাবার দিয়ে গেছে, চলে যেত তবু দু বেলা,
এখন তো কেউ আসে না। লকডাউন প্রাণে মেরে ফেললো গো।
ঝর্না মুড়ি খেতে খেতে বলে, যা বলেছিস । দোকান বাজার খুলতে শুরু করেছে।তাতে কি , ট্রেন না চললে কারোর উপকার নেই। আমাদের এই আস্থানা টুকু আছে, শুধু যা খাবার নেই।দে জলের বোতলটা দে, এতোক্ষণে পেটটা ভরলো।
হ্যাঁ, রে আজ না হয় তোরা একটু নামতাই মুখস্থ বল।
মণিদীপার কথায় সকলেই রাজি হয়ে যায় ।
ওরা নামতা বলতে শুরু করে এক এককে এক, এক দুই য়ে দুই।এক তিনে তিন।
মণিদীপা তদের পড়ার প্রশংসা করে।
একসময় ঝর্না বলে ওঠে, দিদি তুমি আর কতদিন আমাদের মতো ল্যাংড়া, বোবা কালা, অন্ধদের ভিক্ষে করে খাওয়াবে পরাবে আবার শিক্ষাও দেবে!
মণিদীপা বলে যতদিন পা্রবো। যতদিন মাথার ওপর এই ছাদটুকু আছে ততদিন। এ নিয়ে তোদের অতোশত ভাবতে হবে না। এখানে থেকেই তোরা সুস্থ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে যা ।একটু পড়াশোনা করে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে, আর এই ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে, যা কাজ পারবি তাই দিয়ে বাঁচার চেষ্টা কর ।মনে মনে ভাব তোরা সবাই সুস্থ সবল।আর যতদিন না তোদের সবাইকে সে ভাবে ভাবাতে পারছি, ততদিন ই আমার এ লড়াই।
সবাই কেমন মনের একটা জোর পায় ওরা ।
বলে হ্যাঁ হ্যাঁ দিদি আমরা সে ভাবেই বাঁচতে চাই।
মণিদীপা আবার ও শুরু করে কতদিন হয়ে গেল
অনাহারে অর্ধাহারে। এখন তো ঘটা করে বিয়ে অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ কোন অনুষ্ঠান ই হচ্ছে না ।সবেতেই করোনা বিধি, এসব বলতে বলতে মনে পড়ে যায়।
চিৎকার করে বলে এই , খবর আছে রে। ফেরার পথে বিশুদা ই খবরটা দিলো । পরশু, হাঁ পরশুই বললো ,
গোবিন্দপুরে ঘোষ পাড়ায় একটা বিয়ে বাড়ি আছে।
নিয়ম মেনে হলে ও আয়োজন নাকি বেশ। কে যেন
শশিকিরণ ঘোষ তার মেয়ের বিয়ে। অনেক দিন পর বিয়ে বাড়ির খবর পেয়ে সবাই বেশ খুশি।
মণিদীপা বলে ওঠে , এক এক করে তোরা সবাই আমার সঙ্গে যাবি।
হাঁ দিদি আমরা সবাই তোমার কথা মেনে যাবো।আর কতদিন পর আমরা বিয়ে বাড়ি খাব।
মণিদীপা ও উৎসাহ নিয়ে বলে হাঁ হাঁ তাই খাবি । এখন বল দেখি সুন্দর করে, আমাদের ছোট নদী কবিতাটি। বেশ উৎসাহ নিয়ে তারা ও সমস্বরে বলতে শুরু করে , আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে।
বিয়ে বাড়ির সানাই বেজে চলেছে তখনও ।ফেলে দেওয়া পাতার উচ্ছিষ্ট খাবারের ভাগ নিয়ে পাশেই চলছে কুকুরের চীৎকার।বাসি খাবার আর রজনীর গন্ধ মিলে মিশে একাকার।প্যান্ডেলের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় মণিদীপা, একটু দুরে বাকি সকলে।বর কনে বিদায়ের তোড়জোড় চলছে।সে একাই ঢুকে দেখছে সে সব।ভেবে পাচ্ছে না কাকে বলবে কথাটা।
হঠাৎ ই বয়স্ক একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।মণিদীপা এগিয়ে গিয়ে বলে, শুনছেন হাঁ আপনাকে বলছি। আপনাদের খাবার বেশি হয় নি।
ভদ্রলোক পিছু চলে যেতে গিয়ে ও থমকে দাঁড়ায়।
বিস্মিত স্বরে বলে , খাবার বেশি মানে।
মণিদীপা চট করে বলে ওঠে, মানে বাসি খাবার আর কি, ফেলে না দিয়ে যদি আমাদের দেন,আমরা যারা
প্ল্যাটফর্মে থাকি তো একদিন খেয়ে বাঁচি।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মণিদীপার দিকে,
তারপর নিজের মনে কি যেন বলতে বলতে ঢুকে গেল ভেতরে। অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইল সে, মনে মনে ভয় ও হচ্ছিল তার, যদি লোক ডেকে দুর করে দেয়।
কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে ভদ্রলোক, হাঁক দিয়ে বলে, এই যে মেয়ে এসো এসো ভেতরে এসো।মণিদীপা ভেতরে যায়।
তোমার নাম কি গো মা? ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করে।
মণিদীপা
বাহ্ সুন্দর নাম তোমার । মনটা ও এই বলে ভদ্রলোক
এই যে, যা আছে এখানেই, গত রাতের বেঁচে যাওয়া, বাড়তি খাবার। নিয়ে যাও মা, সব নিয়ে যাও।
এরপর হাঁক পাড়ে মণিদীপা, আয় আয়রে ঝর্না, ভোলা, গোকুল, নে সব নিয়ে চল।পরে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য মণিদীপা বলে, বাঁচালেন , এতোসব খাবার ফেলে না দিয়ে আমাদের দিলেন।একটু পরই আপনাদের এই ডেকচি, গামলা সব পরিষ্কার করে দিয়ে যাচ্ছি।হৈ হৈ করে সেই সব খাবার ওরা নিয়ে যেতে থাকে। ভদ্রলোক ভাবতে থাকে, সানাইয়ের সুর টা এখন আর কান্নার মতো করে কানে বাজছে না।
তাকিয়ে থাকে ওদের খুশি ভরা মুখের দিকে। সংসারে খাবারের মতোই কত না বাড়তি অপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে যায়, নষ্ট হয়।যা অন্যের
প্রয়োজনে লাগে।
চললাম, বলে মণিদীপা হাত জোড় করে নমস্কার করে। বাইরে বেরিয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করে তুমি কোথায় থাকো গো মা !
যেতে যেতে মণিদীপা চীৎকার করে বলে প্ল্যাটফর্ম এ
সনৎ ঘোষ
খালোড় বাগনান হাওড়া ৭১১৩০৩