পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে দেশীয় উপাদান ছাড়া কিছুই ব্যবহৃত হয় না দেবতার ভোগ কিংবা অঙ্গরাগে।
আজ থেকে প্রায় ৮০০ বছর আগে তৈরি হয় উৎকলের শ্রী জগন্নাথ মন্দির। কিন্তু জানেন কী চারধামের এক ধাম পুরীর জগন্নাথ মন্দির শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রতিদিন স্বদেশীয়ানার সেরা বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে দেশীয় উপাদান ছাড়া কিছুই ব্যবহৃত হয় না দেবতার ভোগ কিংবা অঙ্গরাগে। এমনকি পুজা অর্চনায় ব্যবহৃত সমস্ত ফল, ফুলও সম্পূর্ণ দেশীয়। মানে অতীতে যে সমস্ত ফুল, ফল বা শাক সবজি একমাত্র ভারতেই উৎপাদিত হত তা ই ব্যবহৃত হয় নীলমাধবের বন্দনায়। এবার দেখে নিই কোন কোন উপাদান পুরীর মন্দিরে প্রবেশ করে আর কোন কোন উপাদান নিষিদ্ধ।
ভোগ নিবেদনে কী কী অদেয় মহাপ্রভুকে?
ভারতে পর্তুগিজদের প্রভাবে আলু আসে প্রথম। যেহেতু উৎসের দিক থেকে আলু ইউরোপিয়ান সবজি তাই আলু জগন্নাথের মন্দিরে নিষিদ্ধ। তার বদলে রাঙা আলু বা মেটে আলু ব্যবহৃত হয়। একই ভাবে পর্তুগিজ প্রভাবেই ভারতে লঙ্কার আগমন তাই তার বদলে গোলমরিচ আর বিভিন্ন শাকের ঝাল মূল ব্যবহৃত হয়। ভারতে গাজর আসে ডাচদের প্রভাবে, টোম্যাটো পর্তুগিজ আর চিচিঙ্গা পূর্ব এশিয়া থেকে তাই এই সব সবজিও ‘দেব ভক্ষ্য’ নয়। আর সেই কারনেই পুরীর শ্রীক্ষেত্রের মন্দিরের ভোগে ব্যবহৃত হয় না টোম্যাটো ,গাজর বা চিচিঙ্গা। ব্যবহার করা হয় না সিদ্ধ চাল। তার পরিবর্তে আতপ চাল দেওয়াটাই চল। সাদা লবনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় সৈন্ধব লবন। কাজুবাদাম দেখতে চিংড়ি মাছের মত বলে তা ব্যবহার হয় না। পরিবর্তে কাঠ বাদাম দেওয়া হয় রান্নায় আর মিষ্টান্নে।
কী মিঠাই জগবন্ধু কালিয়ার পছন্দ?
ছানা এবং ছানার মিষ্টির ব্যবহারও নিষিদ্ধ পুরীধামে। দীর্ঘদিন পুরীর জগন্নাথের ভোগ নিয়ে চর্চা করেছেন চন্দননগরের আলিম্পন ঘোষ। পুরীর মন্দিরের প্রথা অনুসারে নিজের বাড়িতে অধিষ্ঠিত জগন্নাথকে ভোগ নিবেদন করেন আলিম্পন। তিনি বলছেন ‘ছানা’ শব্দটি যেহেতু “ছিন্ন দুগ্ধ” থেকে এসেছে। অর্থাৎ দুধকে কাটিয়ে ছানা করা হয়, তাই ছানা ‘দেব ভক্ষ্য’ নয়। বাংলার বাইরে সর্বত্রই ছানা দেব পরিত্যাজ্য। তার বদলে দুধের সঙ্গে আটা, ময়দা বা সুজি মিশিয়ে তৈরি হয় মিঠাই। এছাড়াও প্রভূত পরিমাণে ক্ষীরের মিঠাই দেওয়া হয় ভোগ হিসাবে। খাজা, রসাবলী, মণ্ডা আর নানান রকমের লাড্ডুও ভোগ নিবেদন করা হয় জগন্নাথকে। এভাবেই তৈরি হয় ৫৬ রকমের ভোগ।
ফল, ফুল ও অঙ্গরাগ উপাচার
শ্রীমন্দিরের দেবতা ও দেবীর অঙ্গরাগের ক্ষেত্রেও ওই একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়। অর্থাৎ দেশে উৎপাদিত উপাচার ব্যবহারের বিষয়টি খেয়াল রাখা হয়। তাই আতর ব্যবহার না করে নিম, হলুদ, কেশর , কস্তুরী , কর্পূর , চন্দন দিয়ে অঙ্গরাগ করা হয়। ফুলের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়। ব্যবহৃত হয় না গোলাপ কিংবা গন্ধরাজ জাতীয় ফুল।
রন্ধন শালার অন্দরে
রন্ধন শালার আগুন কোনও সময়ের জন্য নির্বাপিত হয় না। সেই অনির্বাণ অগ্নিশিখায় নতুন মাটির পাত্রে প্রতিদিন সমপরিমাণ ভোগ রান্না করা হয় মন্দির সংলগ্ন রন্ধন শালায়। কাঠের আগুনে একটির ওপর আর একটি জলপূর্ণ হাঁড়ি বসিয়ে একদম ওপরের হাঁড়িতে রান্না চাপানো হয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর নামানো হয় ভোগ। রান্না চলা কালীন কোনও রকম পরীক্ষা করা হয় না। মন্দিরে যারা রান্নার দায়িত্বে তাঁরা স্নান করে ‘রোষাহোম’ নামক একটি পূজা করে রান্না শুরু করেন। রন্ধন শালার কাজ যারা করেন তাঁরা কোনও সুগন্ধি বা তাম্বুল অর্থাৎ পান খেতে পারেন না।
পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে ব্যবহৃত হয় না কোনও প্রকারের ধাতব বাসনপত্র। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রতিদিন পালিত হওয়া স্বদেশিয়ানার এমন উজ্জ্বল নিদর্শন ভূ-ভারতে মেলা কঠিন।